বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণে বঙ্গপসাগরের নিকটবর্তী বরগুনা জেলাধীন আমতলী উপজেলার সদর ইউনিয়নে খুবই সক্রিয়ভাবে গ্রাম আদালত কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। অত্র ইউপিতে জুলাই, ২০১৭ থেকে ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ পর্যন্ত মোট মামলা দায়ের হয়েছে ১৭৭ টি, নিষ্পত্তি হয়েছে ১৬৫ টি এবং উক্ত মামলাগুলো থেকে মোট ১৬,২০,৭০০/- (ষোল লক্ষ বিশ হাজার সাত শত) টাকা ক্ষতিপুরণ আদায় করা হয়েছে। মিমাংসিত মামলার ৮২/১৮ নং মামলার আবেদনকারী মোসা: খালেদা বেগম একজন খুবই দরিদ্র শ্রেণীর মানুষ, বয়স ৩৫ বছর, পেশা: গ্রহিনী, সংসারের আয়ের একমাত্র অবলম্বন হচ্ছে তার স্বামী। প্রতিদিনের দিন মজুরীর মাধ্যমে অর্জিত অর্থ দিয়ে তার সংসার চলে এছাড়াও হাস-মুরগী পালন করে যা উপর্জন হয় তা দিয়ে এক ছেলে ও এক মেয়ের স্কুল খরচ মেটায়। তার ছেলেটি ৫ম শ্রেণীতে ও মেয়েটি ৩য় শ্রেণীতে পড়াশুনা করে। দরিদ্রতার মাঝেও তাদের সংসার খুবই সুখে চলছিল। মোসা: খালেদা বেগম এর স্বামী মো: মনোয়ার হাওলাদার সংসারে আয়ের উৎস বাড়ানোর জন্য তার চাচাতো ভাই মো: শহিদুল হাওলাদার টিউবওয়েল স্থাপণের মিস্ত্রি এক সঙ্গে কাজ করার জন্য ২ জনে চুক্তিবদ্ধ হয় যে, টিউবওয়েল স্থাপণের জন্য কিছু জিনিস ক্রয় করে একই সঙ্গে কাজ করবে এবং কাজের মাধ্যমে যে লাভ হবে তা ভাগা-ভাগি করে নিবে। মনোয়ার হাওলাদারকে প্রতিদিনের মজুরীও আলাদাভাবে দিবে এ চুক্তি অনুযায়ী মোসা: খালেদা বেগম এর দীর্ঘ দিনের অল্প অল্প করে সঞ্চয় করা কিছু টাকা ছিল। সেখান থেকে ১,২০,০০০/- (এক লক্ষ বিশ হাজার) টাকা শহিদুল হাওলাদারকে দেন। ভালই চলছিল তাদের কাজ ও সংসার। কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাস কাজ করতে যেয়ে হঠাৎ একদিন দড়ি ছিড়ে পরে গিয়ে হাত ও পা ভেঙ্গে যায়। চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। শেষ অবলম্বন সামান্য একটু সম্পদ ছিল তা বিক্রি করে মনোয়ার হাওলাদার এর চিকিৎসা করানোর পরেও সুস্থ্য হয়নি তাই খালেদার দেওয়া ১,২০,০০০/- টাকা শহিদুল হাওলাদার এর নিকট ফেরৎ চান। দু:খের বিষয় হল সে টাকা দিবেনা বলে জানিয়ে দেন তখন প্রথম অবস্থায় খালেদা স্থানীয় গণ্যমান্য লোকদের নিকট বিষয়টি জানান। স্থানীয় সালিশের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে উক্ত ব্যবসার মূলধন ও লাভসহ ১,৩০,০০০/- (এক লক্ষ ত্রিশ হাজার) টাকা প্রদান করার জন্য শহিদুলকে বলেন। উক্ত সিদ্ধান্ত সহিদুল মেনে নেন। শর্ত মোতাবেক কিছু দিন পর ৭০,০০০/- টাকা খালেদাকে দেন বাক ৬০,০০০/- টাকা দেওয়ার জন্য সময় নেন। কিন্তু সময় অতিক্রম হওয়ার ৪-৫ মাস পর্যন্ত খালেদা বেগমকে কোন টাকা দেয় নাই। শুধু দিনের পর দিন ঘুরাইতে থাকে। গত ২৭.০৮.২০১৮ ইং তারিখ শেষ বারের মত খালেদা বেগম টাকার জন্য সহিদুলের বাড়ীতে যান কিন্তু সহিদুল কোন টাকা দিতে পারবেনা বলে জানিয়ে দেন এবং তাকে ভীষণ ভাবে গালমন্দ করে। খালেদা বেগম খুব নিরাশ হয়ে পড়ে। তার স্বামী মো: মনোয়ার হাওলাদার চিকিৎসা চালানো ও ছেলে মেয়েদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যেতে লাগলো সংসার চালানো কোন উপায় ছিলনা। ঘটনাটি যখন সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো: বশির হাওলাদার জানতে পারলেন তখন তিনি ঘটনার সমাধানের জন্য অত্র ইউনিয়নের গ্রাম আদালতে যাওয়ার জন্য পরামর্শ দেন। পরামর্শ অনুযায়ী ০৪.০৯.২০১৮ ইং তারিখ আমতলী ইউনিয়নের গ্রাম আদালতে এসে সহিদুল ও তার পিতা সোবাহান হাওলাদারকে প্রতিবাদী করে ২০ টাকা দিয়ে একটি দেওয়ানী মামলা দায়ের করেন। নিয়মতান্ত্রিকভাবে গ্রাম পুলিশ দ্বারা সমন দেওয়া হয়। ০৭ দিনের মধ্যে উভয় পক্ষ উপস্থিত হয়। কিন্তু প্রতিবাদী ঘটনা অস্বীকার করে। ফলে গ্রাম আদালত আইন অনুযায়ী উভয় পক্ষকে বিচারিক প্যানেলে সদস্য মনোনয়নের নির্দেশ দেয়া হয়। নির্দেশ মোতাবক ০৭ দিনের মধ্যে সদস্য মনোয়ন করে প্যানেলে এক জন নারী বিচারিক সদস্য রাখা হয়। উভয়ের বক্তব্য শোনার পর আপোষ মিমাংসার জন্য ০৯ দিন সময় দেওয়া হয় নিজেরা আপোষে মিমাংশা হতে পারেনাই। তাই পরবর্তীতে গ্রাম আদালতে শুনানীর মাধ্যমে উভয়ের বক্তব্য ও স্বাক্ষীর বক্তব্য শুনে উভয় পক্ষের বিচারিক প্যানেলের মতামতের ভিত্তিতে ৫ঃ০ জনের দোতরফা সূত্রে ৬০,০০০/- (ষাট হাজার) টাকা রায় প্রদান করেন যে, প্রতিবাদী আবেদনকারীকে এক মাসের মধ্যে টাকা প্রদান করিবে। সিদ্ধান্ত মোতাবেক এক মাসের মধ্যে গ্রাম আদালতের মাধ্যমে আবেদনকারী মোসা: খালেদা বেগম ৬০,০০০/- টাকা ফেরৎ পান। উক্ত টাকা পেয়ে খালেদা বেগম তার স্বামীর চিকিৎসা শুরু করেন এবং সংসার পরিচালনার জন্য কিছু হাস-মুরগী ক্রয় করেন এবং তার ছেলে মেয়েরা পুণ:রায় স্কুলে যাওয়া শুরু করে। গ্রাম আদালতের বিচার ব্যবস্থার প্রতি খালেদা বেগম খুবই খুশি। তার অভিব্যাক্তি গ্রাম আদালত না থাকলে আমার এই টাকা কখনও আদায় করতে পারতাম না। খালেদা বেগম তার মনের কষ্টের কথাগুলো বলতে পারছে। চেয়ারম্যান তার প্রতি সদয় হয়ে তার স্বামীর নামে একটি প্রতিবদ্ধি ভাতার ব্যবস্থা করে দেন। খালেদা বেগম এখন সুন্দরভাবে দিনাতিপাত করছে। উক্ত উপজেলার ০৭ টি ইউনিয়নে এভাবে গ্রাম আদালত খুবই সুন্দরভাবে পরিচালিত হচ্ছে। ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ থেকে ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ পর্যন্ত অত্র উপজেলায় গ্রাম আদালতে মোট মামলা দায়ের হয়েছে ৬৪৪টি, নিষ্পত্তি হয়েছে ৫৯৬ টি এবং এই মামলাগুলো থেকে মোট ৪২,৩৫,৪৬১/- (বিয়াল্লিশ লক্ষ পঁয়ত্রিশ হাজার চারশত একষট্টি) টাকা ক্ষতিপূরন আদায় করা হয়েছে।
ফিল্ড পর্যায়ে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা ওয়েভ ভাউন্ডেশন, উপজেলা প্রশাসন ও ইউএনডিপি এর প্রতিনিধিগণ নিয়মিত কার্যক্রমগুলি পরিদর্শন করছে।