বাঙলা কবিতায় আধুনিকতা বিষয়টি কী তা নিয়ে বহুদিন থেকে আলোচনা চলছে। এবং সাথে সাথে চেষ্টা চলছে এর অন্তর্নিহিত ভাব কিংবা নির্যাস বের করে আনার। যে দীর্ঘ কাল-পরিক্রমা নিয়ে আধুনিকতাকে নির্ণয় করতে হয়, বলতে গেলে সাহিত্যে সেই আধুনিকতা হঠাৎ করেই হাজির হয়নি। আর সাহিত্যের ধারাবাহিক গতি-প্রকৃতি একে বিস্তৃতি ঘটিয়েছে কবিতায়ও। ফরাসি বিপ্লব থেকে যে ইউরোপীয় আধুনিকতার জন্ম; সাহিত্যের প্রবাহিত ধারাবাহিকতায় সেটি প্রভাব বিস্তার করেছে ধীরগতিতেই। এর সঙ্গে কাজ করেছে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিকসহ নানান পরিবর্তন। তবে বাঙলা সাহিত্যে আধুনিকতা নামক ধারণার হাওয়া লেগেছে অনেক পরে; ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে। আর কবিতায় এসেছে আরও পরে, বলতে গেলে বিংশ শতকের তৃতীয় দশকে। কিন্তু বাঙালির আধুনিকতার রুদ্ধ ধারাটি মুক্ত করার প্রথম মানস-প্রতিভা ধারণ করেছিলেন মাইকেল মধুসূদন সেই উনিশ শতকের মাঝামাঝিতেই।
আর রবীন্দ্রনাথ এসে সে মুক্ত প্রতিভাকে দিয়েছিলেন তীব্র স্রোত। তবে মাইকেল কিংবা রবীন্দ্রনাথ ইউরোপীয় সেই আধুনিকতাকে গ্রহণ করেছিলেন ব্যক্তি-স্বাতন্ত্রের ক্ষুদ্র সীমানার মধ্যে। ব্যক্তি-স্বাতন্ত্রের ক্ষুদ্র বলয় থেকে বেরিয়ে বাঙলা কবিতা তখনও আধুনিকতাকে পরিপূর্ণরূপে গ্রহণ করেনি। আর তাই মাইকেল থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত কবিতা ছিল পরবর্তী তিরিশের দশক থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। শব্দগঠন, ভাষার শৈলী-বৈচিত্র্য, চিত্রকল্পের অনুভূতি প্রকাশের বিষয়ও ছিল আলাদা। বলতে গেলে মাইকেল থেকে রবীন্দ্র (রবীন্দ্রনাথের পুরো কাল নয়; ১৮৬১-১৯০০ খ্রীষ্টাব্দ) সময় পর্যন্ত বাঙলা সাহিত্যের জন্য ছিল আধুনিকতার প্রস্তুতিকাল। এই সময়েই আধুনিকতা প্রস্তুত হচ্ছিল তিরিশের জন্য। তিরিশের দশকের কবিদের হাতেই বাঙলা কবিতা ইউরোপীয় আধুনিকতাকে পরিপূর্ণরূপে গ্রহণ করে। এর পূর্বের কবিরা আধুনিকতাকে ধারণ করেছিলেন বিচ্ছিন্নভাবে। বিচিত্র প্রতিভা বিকাশের মাধ্যমও ছিল প্রায় সম্পর্কশূন্য।
কিন্তু ত্রিশের দশকের কবিরাই প্রথম আধুনিকতাকে ব্যক্তির উপলব্ধির মধ্যে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন। কবিতায় গ্রহণ করেছিলেন সমগ্রতাকে। কোনো এক নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে তাদের ভাব-উপলব্ধি আবদ্ধ থাকেনি। সবকিছুকে ধারণ করেছিলেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে। কিন্তু প্রকাশ করেছিলেন নিজস্ব ভঙ্গিমায়। আর প্রত্যহ-জীবনের নানান উপলব্ধিকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশ করারই ছিল বিংশ শতকের আধুনিকতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তবে প্রকাশ-রীতির মধ্যেই যে আধুনিকতার বিকাশ ঘটেছিল পরিপূর্ণরূপে তা নয়, বরং এর অন্তনিহিত ভাবও ছিল কবির একান্ত নিজস্ব বিষয়। উদাহরণ তিরিশের কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতা থেকেই দেই- আমি সব দেবতারে ছেড়ে/ আমার প্রাণের কাছে চ’লে আসি/বলি আমি এই হৃদয়েরে;/সে কেন জলের মতো ঘুরে-ঘুরে একা কথা কয়।
পৃথিবীর পথ ছেড়ে আকাশের নক্ষত্রের পথ/ চায় না সে?-করেছে শপথ/ দেখিবে সে মানুষের মুখ?/ দেখিবে সে মানুষীর মুখ?/দেখিবে সে শিশুদের মুখ?/চোখে কালোশিরার অসুখ/কানে যেই বধিরতা আছে? (বোধ; জীবনানন্দ দাশ) ব্যক্তি যে নিজের মধ্যেও স্বতন্ত্র, সেই পৃথক নিজস্ব ভাবনা ও সত্ত্বাকে খোঁজে বেড়ানোই হলো আধুনিকতা। আর এই আধুনিকতায় দেবতা থেকে যেন ব্যক্তির গুরুত্ব অনেক বেশি। দুই প্রাচীন কিংবা মধ্যযুগের সাহিত্যে বেদনাবিদ্ধ উপলব্ধির স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ ঘটলেও চিত্রকল্প অনুভূতির প্রকাশ এতোটা জোরালো ছিল না যতটা আধুনিক কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে। বলতে গেলে, উপলব্ধিকে নিজস্ব ভঙ্গিমায় প্রকাশ বা চিত্রকল্পের অনুভূতিই আধুনিক কবিতাকে আলাদা করেছে প্রাচীন বা মধ্যযুগীয় সাহিত্যের সীমারেখা থেকে। তবে মধ্য বা প্রাচীন সাহিত্যে চিত্রকল্পের অনুভূতি বা অভিজ্ঞতার জোরালো প্রকাশ যে একেবারেই ঘটেনি মোটাভাবে তা বলা যায় না। বরং অনেক ক্ষেত্রেই এটি প্রকাশ পেয়েছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে; অনেকটা আধুনিকতার মতো। শৈল্পিকতার স্বতঃস্ফূর্ততা আর একজন কবি মনের স্বতঃস্ফূর্ত ভাবনার প্রকাশ কিন্তু এক নয়। দুটি ভিন্ন। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে এর অভিন্নতাও লক্ষ্য করা যায়। উদাহরণ হিসেবে বৈষ্ণব পদাবলীর কথা বলা যেতে পারে। ধর্মকে কেন্দ্র করে মধ্যযুগের এই পদাবলী রচিত হলেও ভাষার শৈলী-বৈচিত্র্য, অনুভূতির স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশই এটাকে আধুনিকতায় নিয়ে গেছে। উদাহরণ দেই- সখি কেমনে ভুলিব হিয়া/ আমারই বধূআ আন বাড়ি যায়/ আমারই আঙিনা দিয়া। (বিদ্যাপতি) আধুনিকতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য যদি হয়ে থাকে শৈল্পিক ভাবনা আর চিত্রকল্প অনুভূতির স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ, তবে বৈষ্ণব পদাবলীর অনেক পদেই আধুনিকতার প্রভাব লক্ষণীয়। কিন্তু মধ্যযুগের সাহিত্য বলেই কি কেবল পদাবলীকে আধুনিক হওয়া থেকে অস্বীকার করছি আমরা?
অবশ্যই না! প্রথমেই বলেছি, আধুনিকতা কখনো কোনো কিছুকে বিচ্ছিন্নভাবে গ্রহণ করে না। সমগ্রকে নিয়েই তার অবস্থান। বৈষ্ণব পদাবলীতে একদিকে যেমন প্রকাশ পেয়েছে জীবন-উপলব্ধির একচ্ছত্র ভাবনা-চিত্রের স্বতঃস্ফূর্ততা, অন্যদিকে পেয়েছে এর ধর্মীয় তত্ত্বকথা। অর্থাৎ বৈষ্ণব পদাবলীতে শৈল্পিকতার স্বতঃস্ফূর্ততা ঘটলেও কবির মানস-প্রকৃতির একটি বিশাল অংশ জুড়ে ছিল ধর্ম-চেতনা। ধর্মকে উদ্দেশ্য করেই বৈষ্ণব পদাবলী রচিত। তাই বৈষ্ণব পদাবলীর আঙ্গিকগত দিক আধুনিক হলেও এর বিষয়বস্তু ছিল সম্পূর্ণ ধর্মাশ্রিত। তিন আধুনিক কবিতা বলতে অনেকেই গদ্যছন্দকে বুঝে থাকেন। আবার অনেকে মনে করেন, আধুনিকতা নামক নির্মম ধারা কবিতাকে তার মৌলিক আদর্শ থেকে অনেকটা দূরে নিয়ে গেছে। কিন্তু এ ধারণা অনেকাংশেই ঠিক নয়।
আধুনিক কবিতা সময়ের ব্যবধানে আর সাহিত্যের ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় একটি নিজস্ব ধারা সৃষ্টি করে নিলেও তার মৌলিকতার বিচ্যুতি হয়েছে; এমন ধারণা মনে করার কোনো কারণ নেই। বিশেষ করে, কবিতার অনুভূতি বা চিন্তাস্পর্শের কোনো মৌলিকতাই আধুনিক কবিতার কোনো মৌলিক বিষয়কে ম্লান করেনি। সময় বদলের সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেক যুগের কবিতাই যেমন একটি ধারা সৃষ্টি করে নেয়, সে দৃষ্টি আধুনিক কবিতার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তাই বাঙলা কবিতা-সাহিত্যের ধারাবাহিকতায় রবীন্দ্র সময় পর্যন্ত যে-কবিতা ছিল প্রতিনিধিত্বমূলক; তিরিশের আধুনিক কবিদের হাতে এসে হয়ে গেল সেটি সম্পূর্ণ ব্যক্তি চিত্তের অনুভূতি প্রকাশ। যার ফলে আধুনিক কবিতা হয়ে উঠলো আধুনিক কবিদের ব্যক্তি উপলব্ধির লীলা-চৈতন্যের সহচর। তবে এটাও ঠিক যে আধুনিক কবিতা সকল মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে না, একটি নির্জন একান্ত উপলব্ধি-প্রতীক হয়ে ওঠে আধুনিক কবিতা। চার ব্যক্তি হৃদয়ের ভাবের দ্যোতনা, চিন্তা বা অন্তর-অনুভূতির কথাগুলো যখন একটি নির্দিষ্ট শৈল্পিকতার মধ্যদিয়ে প্রকাশিত হয় তখনই তা হয়ে ওঠে আধুনিক কবিতা। বিশেষ করে, কবিতা বা গদ্য সাহিত্যের বেলায় আধুনিকতা বিষয়টি তার পূর্ববর্তী রচনার ওপর কিছুটা হলেও নির্ভর করে।
এক্ষেত্রে, সাহিত্যের যে দীর্ঘ ইতিহাস কালের স্রোতে প্রবাহিত, সে বহমান ধারায় কবিতা কতটুকু আধুনিক তার একটি তুলনামূলক প্রশ্ন রয়েই যায়। তাই সময়ের ব্যবধানে আধুনিকতার বিষয়টি তার সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে থাকে। একে রুখা যায় না। সম্ভবও নয়। তার আপন ধারায় মধ্যদিয়ে সে প্রবাহিত হয়। একমাত্র আধুনিক কবিতায় একজন কবি পারেন তার মনের চিরচেনা সাধারণ কথাগুলোকে এক উচ্চমার্গীয় শৈল্পিক প্রতিভার দ্বারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশ ঘটাতে। আর ‘শৈল্পিকতার স্বতঃস্ফূর্ত’ প্রকাশই আধুনিক কবিতাকে মধ্য বা প্রাচীন যুগের কবিতা থেকে করেছে ভিন্ন। যার ফলশ্রুতিতে ব্যক্তি তার ধারাবাহিক শিল্প-উপলব্ধি’র বিকাশ ঘটিয়েছে কবিতায়, বীজ বপন করেছে সংস্কৃতি মননের। তবে জ্ঞান, বুদ্ধি বা চিন্তার আশ্রয়ই কেবল শিল্পের প্রকাশ নয় বরং শিল্পের স্পর্শে এসেই জ্ঞানের স্ফূরণ আর বুদ্ধির তীক্ষ্ণ প্রকাশ ঘটেছে আধুনিক কবিতায়। এই উপলব্ধিবোধ থেকে হয়তো জীবনানন্দ দাশ বলেছেন-‘সকলেই কবি নয়। কেউ কেউ কবি।’ তাই কবি হৃদয়ের চিত্রকল্পের অভিজ্ঞতার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশই ব্যক্তির কথাকে কবিতায় রূপান্তরিত করে।
কথা হলো- শিল্পের প্রকাশই কবিতা নয়; বরং এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভাব-অভিজ্ঞতা আর দৃশ্য কল্পনার এক অদৃশ্য ধারাবাহিক বন্ধন। এই বন্ধনের ক্ষমতা খুব অল্প সংখ্যক কবির মধ্যে বিরাজ করে যার ফলশ্রুতিতে তদের কবিতা হয়ে উঠে মহৎ। যদি এভাবে বলা যায়-একজন কবি যখন তার পৃথিবীর সর্বময় অন্তর্নিহিত কথাকে- যা তিনি বুঝাতে চান তা- যখন একটি নির্দিষ্ট শিল্পের মাধ্যমে প্রকাশ করেন তখনই তা কেবল কবিতা হয়ে ওঠে। প্রশ্ন উঠতে পারে- শিল্পের মূল্য যদি হয় ব্যক্তি-বিশেষের কাছে ভিন্ন, তবে শিল্প কি আপেক্ষিকতার পরিচয় দেয়? উত্তরে বলা যায়- আপেক্ষিকতার প্যাঁচে না জড়িয়ে শিল্পকে সর্বজনীনভাবেও ব্যাখ্যা করা যায়। তবে তার ব্যবহার ব্যক্তি স্বাতন্ত্রের মধ্যে ভিন্ন আবেদন আনতে পারে। সৃষ্টি করতে পারে আঙ্গিক বৈচিত্র্যের স্বতন্ত্র ধারাবাহিকতা। আর এ উপলব্ধিবোধ থেকে হয়তো কবিকে জ্ঞানস্রষ্টা না হলেও চলে, তবে তাকে শিল্পস্রষ্টা অবশ্যই হতে হয়। কেননা শিল্পের মধ্যে সবকে প্রকাশই হলো একজন যথার্থ আধুনিক কবির কাজ।
লেখক : এমএইচ মোবারক, জন-সংযোগ কর্মকর্তা, উত্তরা ইউনিভার্সিটি।